একবার কে যেন বলেছিল, ছোটগল্প শুরু করতে হয় চমক দিয়ে, শেষ করতে হয় আচমকা। আইডিয়াটা খারাপ না। চমক দিয়ে, মানে, ঘুম থেকে উঠে বিছানায় স্বামীর রক্তাক্ত লাশ দেখে চমকে উঠলো সাদিয়া, কিংবা রহমান সাহেব বাড়ি ফিরে দেখেন তার বাজারের ব্যাগে তিনটি একচোখা গোখরা সাপ, কিংবা একটা রজনিগন্ধা কামড়ে ধরে এগারো তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে নাজমুস সাকিব — এভাবে গল্পের শুরু করা যায়; চমক দিয়ে। অথবা আপনি যদি চান, তাহলে শহীদুল জহিরের মতোও শুরু করতে পারেন। যেমন তিনি তার ধুলোর দিনে ফেরা গল্পটি শুরু করেছেন এভাবে, — আবদুল ওয়াহিদের সুহাসিনীতে প্রত্যাবর্তনের খবর গ্রামের লোকেরা প্রথম জানতে পারে গ্রামের মুদি দোকানদার তোরাপ আলির কাছ থেকে; সুহাসিনীর লোকদের ভেতর যারা তাকে আগে দেখেছিল তারা সেদিন রাতে অনেকক্ষণ জেগে থেকে করপুটে কলকি চেপে তামাক খায় এবং তাকে নিয়ে কথা বলে এবং তাদের এই ভাবনা হয় যে, সে এখন গ্রামে কী করবে; এবং গ্রামে যারা তাকে চিনতে পারে না, তাদেরকে তারা কলকিতে লেগে যাওয়া থুতু হাতের চেটোয় মুছে নিয়ে বলে, নকশাল আছিল, কারণ আবদুল ওয়াহিদের কথা শোনার পর তার এই পরিচয়টি প্রথম মনে আসে।
চমক আছে, তাই না? অথবা চমক নেই। কিন্তু এভাবে ক’জন গল্পকার তাদের গল্প শুরু করেন? শহিদুল জহির সবার চেয়ে আলাদা। তিনি গল্প লিখেন, কিন্তু সেই গল্প বলে মহল্লার লোকেরা, অথবা গ্রামের লোকেরা, অথবা অনেক মানুষ একসাথে। যেমন আবদুল ওয়াহিদের এই গল্প প্রথমে মহল্লার লোকেরা জানতে পারে, তারপর হয়তো মহল্লার লোকদের কাছ থেকে লেখক জানতে পারেন, অথবা পারেন না, অথবা তিনি মনে করতে পারেন না গল্পটি কীভাবে জেনেছেন, কিন্তু তিনি জেনেছেন, এবং সেই গল্পটি লিখেছেন।
যখন গল্পের প্রধান চরিত্রের মৃত্যু নিয়ে কোনো গল্প লেখা হয়, তখন একশ জনের মধ্যে নব্বই জন লেখক সেই মৃত্যুকে পুঁজি করে পাঠক ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। গল্পের একেবারে শেষে টুইস্ট অথবা ট্র্যাজেডি হিসেবে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করবেন। বাকি নয় জন লেখক হয়তো শুরুতে অথবা মাঝামাঝিতে বলে দিবেন, কিন্তু কোনো একটি চরিত্র হয়তো সেই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করবে, এবং পাঠক তার টানে আটকে থাকবে। একশ জনের মধ্যে মাত্র একজন লেখক গল্পের একেবারে শুরুতেই, হয়তো প্রথম অথবা দ্বিতীয় প্যারায় চরিত্রটির মৃত্যুর কথা এবং মৃত্যুর কারণ, সবকিছু বলে দিবেন, তবুও আপনি গল্পটি পড়বেন, কারণ এটি লিখেছেন শহীদুল জহির। ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’র বেলায় তিনি উপন্যাসের নামেই বলে দিয়েছেন, ব্যাটা মরে গেছে। তবুও আমরা সেই উপন্যাস কত আগ্রহ নিয়েই না পড়েছি।
ধুলোর দিনে ফেরায় ফিরে আসি। এই গল্পে অনেকগুলো গ্রামের কথা এসেছে, যেমন সুহাসিনী, নলকা, ধুবিল, সলঙ্গা, ভদ্রঘাট, জামতৈল, ইত্যাদি। এক সাক্ষাৎকারে শহীদুল জহির বলেছেন, তিনি নাম নির্ণয় করতে পারেন না, তাই পত্র-পত্রিকায় কোনো নাম পড়ে ভালো লাগলে টুকে রাখতেন, এবং একই নাম বিভিন্ন গল্পে ব্যবহার করতেন। যেমন সুহাসিনী নামের গ্রাম তার অন্য গল্পেও পাওয়া যায়। আবার এই গল্পের একটি চরিত্র, আকালু, তার অন্য গল্পেও আছে। এভাবে তোরাপ আলি এবং আরো কিছু নামও আছে।
ধুলোর দিনে ফেরা আবদুল ওয়াহিদ নামের এক মানুষের গল্প, যৌবনে যে কি না কালো ছিল, শীর্ণ ছিল, অথচ তার সবল দেহ ও প্রবল চেহারার হাসিতে আনন্দ ছিল। তার চোখের আলোতে ছিল স্বপ্নের গভীরতা। আর এসব স্বপ্নময়তার কারণে আবদুল ওয়াহিদ সংঘব্ধতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং নকশালে যোগ দেয়। তখনই তার বন্ধু আবুল হোসেনের প্রসঙ্গ আসে। শহীদুল জহির তার গল্পে লিখেছেন, আবুল হোসেনের দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্ন ছিল না, ছিল না সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের বেপরোয়া আকাঙ্ক্ষা, তাই সে তার ছোট বৃত্তের জীবনের ভেতর টিকে যায়। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ আবদুল ওয়াহিদ যখন একুশ বছর পর গ্রামে ফিরে আসে, তখন তাকে একটি ধ্বংসস্তূপ বলে মনে হয়। তখন গ্রামের লোকেরা বলে, আবদুল ওয়াহিদ মরার জন্য ফিরে এসেছে। এবং সত্য সত্য একদিন সে মরে যায়, তার পুরোনো কোনো প্রতিপক্ষের হাতে। অথচ প্রথমবার আক্রমণের সময় আবদুল ওয়াহিদ ঠিকই বুদ্ধি খাটিয়ে বেঁচে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেন সে ইচ্ছে করেই খুন হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
তখন আসে প্রেমের কথা, নূরজাহানের কথা। নূরজাহান এখন আবদুল ওয়াহিদের বন্ধু আবুল হোসেনের বিবাহিত স্ত্রী। তাতে কি, নূরজাহান তো আবদুল ওয়াহিদের প্রেমিকা ছিল না, বৌও ছিল না; সে যখন সুহাসিনী ছেড়ে চলে যায় তখন নূরজাহানের বয়স মাত্র দশ কি এগারো, তাহলে আবদুল ওয়াহিদ গ্রামে এমন কী রেখে গিয়েছিল যে, এতদিন পর ফিরে এসে তা খুঁজে না পেয়ে সে মরে যেতে চাইল? শহীদুল জহির সম্ভবত সেই গল্পই লিখেছেন। অথবা তিনি কেবল গ্রাম, পুরুষ, নারী, পাখি ও ফুলের গল্প লিখেছেন। এই গল্পে পাখি আছে। পাখির নাম শালিক, আর ময়না। গল্পে ফুল আছে। ফুলের নাম গোলাপ। ফুল আর পাখির আলাপে একটু পরে আসছি। তার আগে জাদুবাস্তবতার কথা বলি।
শহীদুল জহিরের প্রসঙ্গ এলেই জাদুবাস্তবতার প্রসঙ্গ আসে। অনেকে মনে করেন এটা তিনি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর কাছ থেকে নিয়েছেন। যদিও এক সাক্ষাৎকারে লেখক স্বয়ং বলেছেন, এক্ষেত্রে তিনি মার্কেজ দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে লেখার বেলায় তিনি বোধহয় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দ্বারা। এবং ধুলোর দিনে ফেরা গল্পটি তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্মৃতির উদ্দেশ্যে লিখেছেন।
গল্পের নামের কথা বলি। ধুলোর দিনে ফেরা। এই গল্পের নাম সুহাসিনীর নাম অনুসারে হতে পারতো, হতে পারতো আবদুল ওয়াহিদ, কিংবা নূরজাহান, কিংবা বিপ্লব, অথবা শালিক আর ময়না পাখির নামে। কিন্তু গল্পের নাম হয়েছে শীতের শুষ্কতার পর ধুলোয় যখন চরাচর আচ্ছন্ন হয়েছিল এবং ফাল্গুনের প্রথম থেকে আউশের বীজ ফেলার জন্য তারা প্রথম বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল, তখন গ্রামের মানুষ যে ধুলোর ভেতরে চলাচল করতো, তার নামে। এই গল্পের নামে যেমন একটা ঘোর আছে, মাতাল আবহ আছে; শহীদুল জহির গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ঘোর, একই নেশার দোল বয়ে নিয়ে গেছেন। গল্পের শালিক পাখি কথা কয় না, বাস্তবেও না। ময়না পাখি কথা কয়। কিন্তু এই গল্পে দু’টি ময়না এক খাঁচায় রাখলে ময়না পাখিও কথা কয় না। তাদেরকে আলাদা খাঁচায় রাখলে, অর্থাৎ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলেই কেবল তারা কথা কয়। আবার অন্যদিকে গোলাপ গাছের চারার সাথে কথা না বললে সে কেবল বেড়ে ওঠে, কিন্তু ফুল দেয় না। আর যখন কথা বলে, তখন ফুল দেয়। মানুষের বেলায়ও যেন তেমনই। মানুষ যখন একসাথে থাকে, তখন কথা কয় না, সম্পর্ক বিকশিত হয় না, ফুলও ফোটে না। নূরজাহানের সাথে আবদুল ওয়াহিদের সম্পর্ক , অথবা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক এসব রূপক অর্থে ফুটে উঠেছে শহীদুল জহিরের এই গল্পে, এবং পুরো গল্পের সারমর্ম পাওয়া যায় গল্পের ভেতরেই, ছোট্ট একটা অংশে।
আবদুল ওয়াহিদ খেয়াল করে যে, সকাল-বিকেল পানি দেয়া সত্ত্বেও গোলাপের ডালের মাথায় লাগানো গোবরের ভেতর নতুন পাতা অঙ্কুরিত হয় না, তবে ডালটা মরেও যায় না, কারণ কাঁটাওয়ালা ডালটার সবুজ রং পরিষ্কার চোখে পড়ে। তখন এই জীবন্মৃত গোলাপ গাছের গোড়ার মাটি খুরপি দিয়ে আলগা করে দেয়ার সময় আবদুল ওয়াহিদের মনে হয় যে, গাছটা বোধ হয় ঘুমায় এবং তখন সে বিড়বিড় করে হয়তো নিজের অজান্তেই গাছের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে, এত ঘুম আপনের, আর কত ঘুমাইবেন, এইবার ওঠা লাগে! গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন এই গাছের তন্তুর ভেতরে বহুদিন পূর্বেকার স্মৃতি জেগে ওঠে এবং এই গাছ মানুষের কথার ধ্বনি শনাক্ত করতে পারে এবং পরদিন সকালে পানি দিতে গিয়ে আবদুল ওয়াহিদ দেখতে পায় যে, গোবরের ভেতর থেকে একটি অঙ্কুর বেরিয়ে এসেছে এবং হালকা বাদামি রঙের তিনটি কচি পাতা ভোরের বাতাসে বিকশিত হয়ে আছে। … গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন সে সম্ভবত নিজের জন্য পুনরায় একধরনের স্বপ্ন গড়ে তোলে। কিন্তু ফুল ফোটা, পাখির কথা বলা এবং পাকা ফসল ঘরে তোলার পূর্বেই সে তার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এবং গ্রামের লোকদের বিভ্রান্তি হয়, তারা বলে যে, সে মরার জন্যই গ্রামে ফিরে এসেছিল।
আমার পড়াশোনা বেশি না। তবে যত ছোটগল্প পড়েছি, অন্তত শহীদুল জহিরের যত ছোটগল্প পড়েছি, তার মাঝে ধুলোর দিনে ফেরা, আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে। শহীদুল জহির এমনিতেই সারাজীবন তার লেখা সাহিত্যকে একটা নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন, একেক গল্প একেকভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই গল্পটি তিনি যেভাবে বলেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না।
খুব ছোট একটা গল্প, একটা গ্রাম, অল্প কিছু চরিত্র, কিন্তু এর মধ্যে কত ডালপালা, কত স্তর, আর তার কত বিস্তার!
প্রেম? প্রেমের কথা আর কী বলবো, যখন লেখক নিজেই সব বলে দিয়েছেন।
…নূরজাহান যেদিন বলে যে, কান্নার সময় একা নারীর সামনে যেতে নেই, সেদিন তখন মুখের ভেতর শেষ লোকমার ভাত নিয়ে আবদুল ওয়াহিদ বিভ্রান্ত বোধ করে এবং এই বিভ্রান্তির ভেতরও তখন একধরনের ভয় জেগে ওঠে এবং এরপর কয়েকদিন সে আবুল হোসেনের বাড়ি এড়িয়ে চলে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, পালানোর এই প্রচেষ্টা অর্থহীন ছিল, কারণ সুহাসিনী একটি ছোট জায়গা, এখানে পালিয়ে থাকার জায়গা নেই, এবং নূরজাহানও তাকে লুকিয়ে থাকতে দেয় না। কয়েকদিন পর আবুল হোসেনের বাড়িতে যেদিন আবার তার দাওয়াত আসে, সেদিন আবুল হোসেনকে বাড়িতে দেখা যায় না, তখন সে বলে, এইটা ঠিক কাম করিস নাই; এবং গ্রামের লোকেরা তখন এইসব কথা বিশদ বর্ণনা করে, তারা বলে যে, আবদুল ওয়াহিদের কথা শুনে নূরজাহান বুঝতে পারে সে কী বলে, কিন্তু সে তার এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলে, কুয়াতলায় একা একা কেন কান্দি আপনের জাইনব্যার ইচ্ছা করে না? এই কথা শুনে আবদুল ওয়াহিদ বিমূঢ় হয়ে পড়ে, সে বুঝতে পারে না নূরজাহান এইসব কথা কেন বলে; তখন সে সাবধান হওয়ার কথা ভাবে এবং নূরজাহানের বিপজ্জনকরূপে ব্যক্তিগত প্রশ্নটির উত্তর না দিয়ে নীরব থাকে। …গ্রামের লোকেরা বলে যে, সেদিন রাতে আবদুল ওয়াহিদের ঘুম আসে না; কারণ অনেক রাত পর্যন্ত তাকে একা কাচারিঘরের বারান্দায় বসে থেকে থেলো হুঁকোয় তামাক খেতে দেখা যায়; সেদিন সারা রাত সে অন্ধকার, হুঁকোর তামাকের ঘ্রাণ এবং একরকমের বিষন্নতার ভেতর নিমজ্জিত হয়ে থাকে এবং তারপর এইসব জটিলতার কোনো এক পর্যায়ে সে জীবনের প্রতি আগ্রহী হয় এবং পুনরায় নিজের জন্য এক জগৎ গড়ে তোলে।
One Response
আপনার লেখা পড়লাম। এরপর শহীফুল জহিরের গল্পটা পড়লাম। শেষে আবার আপনার লেখাটা পড়লাম।
আপনার লেখাটা ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু শহীদুল জহিরের গল্পটা বোরিং লেগেছে। আমি কখনোই উনার কোন গল্পের সাথেই কানেক্ট করতে পারিনি। আমার ব্যর্থতা।