Search

ছোটগল্প: জলযাত্রা

যখন নদীর কিনারে সাদা সাদা কাশফুল ফুটে রয়, আর ভাদ্র মাসের গরমে পেকে যাওয়ার ভয়ে তালের সাথে পাল্লা দিয়ে চালতাও মন খারাপ করে, যখন বাড়ির পেছনে গগনশিরীষ গাছের ফুল উঠানে উড়ে এসে ছাতিমের সাথে একসঙ্গে ঝরে পড়ে, তখন আশি বছর বয়সী বৃদ্ধ আবুল হাশিমের ইচ্ছে করে মৃত্যুশয্যা থেকে এখনই উঠে যায়।
আবুল হাশিম বিছানা থেকে উঠে যায়। উঠে বাড়ির সামনের রাস্তায় যায়। কারো মরার সময় হলে গ্রামের সবাই মৃত্যুপথযাত্রীর বাড়িতে গিয়ে ভিড় করে, এখন যেমন ভিড় করে আছে আবুল হাশিমের বাড়িতে। জনপ্রাণহীন রাস্তায় আবুল হাশিম একা একা হেঁটে যায়, কেউ তাকে দেখতে পায় না।
নদীর পাড়ে গ্রাম হলে যেমন হয়, — মানুষের ভয়ে নদীটি ছোট হতে হতে, সরু হতে হতে, মরে যেতে যেতে কেবল বর্ষায় ধড়পড় করে জেগে ওঠে। এবং আশ্বিনের রাতে যদি পূর্ণিমা থাকে, ধবধবে জোছনায় নদীটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে অগ্রহায়ণে মরে যায়। কিন্তু গ্রামের সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না, যেমন শেষ হয়ে যায় না মৃত স্ত্রীর সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক; ঝুলে থাকে ঘরের বেড়ায় শুকনো ফুলের মালাসহ মরহুমার ছবি।
যোগাযোগের চিহ্ন হিসেবে একটি ঘোলাটে সাদা বালুর রাস্তা গ্রাম থেকে কেবলই নদীর দিকে চলে যায়। রাস্তার দুই ধারে থাকে আশশেওড়ার ঝোপ আর তাতে ফুটে রয় সবুজ সবুজ ফুল; মৌমাছি এসে খানিক বসে মধু মুখে করে চলে যায় সুইচোরা পাখির পেটে। ঝোপের ঠিক পেছনে পাখিদের বাসা থাকে। আবুল হাশিম দেখে কীভাবে একটি সুইচোরা পাখি বসে থাকে একটি মৌমাছির আশায়।
সূর্য মাথায় করে আবুল হাশিম হেঁটে যায় সাদা ঘোলাটে বালুর রাস্তায়; ভাবে এ যেন তাপহীন মিঠা রোদ, তবু আবুল হাশিম ঘামে ভিজে যায়, তার গলা শুকিয়ে যায়, দারুণ পিপাসা পায়, যখন যুবতী ঘরানার মেয়ে-মানুষ শেফালী, কতইবা বয়স তার, ষোলো কী সতেরো — দল বেঁধে ফিরে আসে নদীর কিনার থেকে, কোমরে ঠেকিয়ে আধুনিক অ্যালুমিনিয়ামের কলস।
বিলাপ করে হাসে শেফালী; চোখে মুক্তোর দানা চিক চিক করে জ্বলে ভাদ্র মাসের রোদে। জীবনের সমস্ত যৌবন নিয়ে শেফালী বসে পড়ে ঘোলাটে সাদা রঙের বালুর গায়ে, যেমন করে ঝরে পড়ে হাসনাহেনা; স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার ওপর। সখীরা সারি বেঁধে এসে শেফালীর গায়ে জল ঢেলে দিলে, শেফালীর শাড়ি ভিজে গেলে, গা ভিজে গেলে, মন ভিজে গেলে সখীদের খালি কলস বেজে ওঠে বিচ্ছেদী গানের সুরে।
মৃত্যুপথযাত্রী আবুল হাশিমের শুকিয়ে যাওয়া গলা জীবনের সর্বশেষ নিঃশ্বাসের দামে এক আঁজলা জল কিনতে চায়। যুবতী ঘরানার মেয়ে শেফালী আবুল হাশিমের চোখে চোখ রেখে হাসে, আর ঠোঁট কামড়ায়, আর কোমরে আধুনিক অ্যালুমিনিয়ামের খালি কলস ঠেকিয়ে দল বেঁধে জল আনতে যায়।
আবুল হাশিম ভাবে জনপ্রাণহীন রাস্তায় কেউ তাকে দেখতে পায় না। শুধু একটি হলুদ পাখি শ্যাওড়া গাছের পাতার ফাঁকে বসে বসে রসালো ফল খায় আর গ্রামে যেমন হয়, — একটি লোক থাকে কীভাবে যেন সবকিছু দেখে ফেলে, শুনে ফেলে, বুঝে ফেলে, এবং লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরু চুলকায়, আর রহস্যজনকভাবে হেসে হেসে টাকা চায়। আবুল হাশিম তাকে টাকা দেয়। লোকটি হাসি বন্ধ করে, মুখ বন্ধ করে, লুঙ্গি ধরে ধরে আশশেওড়ার ঝোপের আড়ালে চলে যায়।
সাধারণত ভাদ্রের দুপুরে এক ঝাঁক গাঙশালিক, যাদের গায়ে থাকে তেলতেলে পালক এবং তা রোদে ঝলসে যায়, আর এসব শালিকের ঠোঁটের পাশে, চোখের পাশে আগুন জ্বলে; ডানা মেলে উড়ে যায় নদীর দিকে। আবুল হাশিম একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পাখির ঝাঁকের দিকে, আর বালুর রাস্তা ধরে পায়ে পায়ে হেঁটে যায় নদীর বালুচরে।
আশি বছর বয়সী বৃদ্ধ আবুল হাশিমের এখন আর ঠিকমতো মনে থাকে না; সে ভুলে ভুলে যায়, নিজের কাছে নিজে জানতে চায়, — এতদূর কীভাবে এলাম?
আবুল হাশিম চুপ করে থাকে, সে কথা কয় না। লোকের বয়স বেড়ে গেলে ঠিকমতো শুনতে পায় না, বুঝতে পায় না কিছুদূরে তার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে সামান্য এক জলের নদী, যার নাম হয় মহুয়া।
নদীর তীরে ফাঁকা জায়গা থাকলে কাশবনের পাশে অচেনা কোনো গাছ অথবা মরা হিজলের কাছে ভাদ্র মাসে পড়ে থাকে একটি পুরোনো ভাঙা নৌকা, যার ভাঙা কাঠের ফাঁকে ফাঁকে বেড়ে ওঠে মালঞ্চ শাক, তাতে সাদা সাদা ফুল ফুটে রয়। অনেক সময় এসব ভাঙা নৌকার কাছে ফুল ফুটলে সেখানে কয়েকটি প্রজাপতি ওড়ে, এবং একটি ছোট পাখি এসে গলুইয়ের ওপর কেবলই বসে থাকে আর ঘাড় ঘুরিয়ে অকারণে এদিক সেদিক চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকে পাখিটিকে দেখে না, এরচেয়ে বড় কিছু, যেমন নদী, অথবা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সূর্যের আলো সরাসরি আবুল হাশিমের মুখের ওপর পড়ে। সে তাকিয়ে থাকে মহুয়া নদীর দিকে, সেখানে ঝিরিঝিরি বাতাসে এমন মিনমিনে ঢেউ ওঠে, যেন স্রোতহীন নদীতে বসে থেকে থেকে, গরমে পুড়ে যেতে যেতে, মরে যেতে যেতে জলের শরীর আর চলতে চায় না। পাশে পড়ে থাকা ভাঙা লগি হাতে নৌকার গলুইয়ের ওপর বসে আবুল হাশিম যেন পুরোনো দিনের গানের অনুষ্ঠান এবং অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনে।
এমনও-তো হতে পারে, — অনেকদিন আগে এক শ্রাবণ বিকেলে টানা সাত দিন ধরে বারিষ ঝরছিলো; ঝরবে আরো দুই একদিন। হয়তো ঘরে বসে বসে, শেফালীর সাথে থেকে থেকে, বাহিরে না যেতে যেতে আবুল হাশিমের দম বন্ধ হয়ে আসে। হয়তো সে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে গিয়ে কারো দোকানের পেছনে বসে তাস খেলতে, অথবা হাত দেখানোর নাম করে গণক ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে তাদের চালাঘরের নিচে গল্পের আসর জমাতে চায়।
হয়তো সে সময়, আবুল হাশিমের খুব মাথা ধরে, এবং শেফালী তার জন্য চা বানাতে যায়। শেফালী চা বানাতে গেলে, ঘরে তার কোনো শব্দ না পেলে, আবুল হাশিম একবার উঁকি দিয়ে চায়। তারপর বিছানা থেকে উঠে একটা ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় যায়। তখন ঝুর-ঝুর বৃষ্টি ঝরছিলো এবং পেছন ফিরে না চেয়ে আবুল হাশিম কেবলই ছুটে যাচ্ছিলো।
হয়তো কিছুদূর গেলে, বালিকা বধূ শেফালী তার স্বামীর নাম ধরে ডাকে, আর দৌড়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, — আমারে ফাঁকি দিয়া কোন সুন্দরীর লগে লীলা করতে যাইতেছো আবুল হাশিম?
শেফালী তার সুদর্শন স্বামীর পিঠে লেপ্টে থাকে, আবার বুকে লেপ্টে থাকে, আবার পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার সাথে সাথে হাঁটে। পাশের বাড়ির রশিদ কাকার বৌ জোহরা চাচী যখন ঘরের ভেতর জানালার পাশে বসে দোলনচাঁপা ফুল আর পাতার ফাঁক দিয়ে তাদের চোরা চোখে দেখে, শেফালী তখন ছাতা ফেলে দিয়ে আবুল হাশিমের সাথে বৃষ্টিতে ভিজে আর মনে মনে হাসে।
আবুল হাশিম জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। শেফালী তাকে মহুয়া নদীর তীরে নিয়ে যায়। নদীর কী দেমাগ! উপচে পড়া জলে বড় বড় ঢেউ, স্রোতের সে কী টান! যেন সে আর কখনো শুকিয়ে যাবে না, যেন সে আর কখনো মরে যাবে না, যেন তার যৌবন সবসময় এমনই রবে; যেমন রয় আকাশের, সমুদ্রের।
বর্ষায় গ্রামে কিছু লোক থাকে, যারা নদীর কূলে হিজল গাছের সাথে তাদের নৌকা বেঁধে রাখে। শেফালী সাঁতার জানে না, নৌকা বাইতে জানে না, কিন্তু স্বামীর সাথে নৌকায় চড়ার বড় শখ তার। আবুল হাশিম বৌকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। হয়তো হিজল গাছের ফুল; ঝরে পড়ে পড়ে ভেসে ছিলো নৌকায় জমে থাকা জলে। আবুল হাশিম জল সেঁচে দিলে শেফালী নৌকার পাটাতনে বসে।
স্বামীর সাথে, প্রেমিকের সাথে নৌকায় চড়ে কিছুদূর গেলে বালিকাদের মনে, যুবতীদের মনে প্রেমের দোলা লাগে। তারা ছোট নৌকার ছোট পাটাতনে উঠে দাঁড়াতে চায় এবং স্বামীর চোখে চোখ রেখে কাঁপা কাঁপা পায়ে শেফালী উঠে দাঁড়ায়।
শেফালীর ভেজা শাড়ি আর ভেজা ব্লাউজের তলে বুক ধড়পড় করে। আবুল হাশিম বুকের সেই ওঠানামা দেখে। ছোট নৌকার সামান্য পাটাতনে শেফালী পড়ে পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। তখন নৌকা দুলে দুলে ওঠে। শেফালীর চুল বেয়ে, গলা বেয়ে, পেট বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে। আবুল হাশিম দেখে এবং তার বুক ধড়পড় করে। তখন নৌকা দুলে দুলে ওঠে। শেফালি খিলখিল করে হাসে, দুই হাত পাখির ডানার মতো মেলে পাখির মতো করে ভাসে। এবং তার বুক ধড়পড় করে। আবুল হাশিমের বুক ধড়পড় করে। নৌকা দুলে দুলে ওঠে।
যখন কেউ সাঁতার জানে না, এবং ডুবে যাওয়ার ভয়ে শরীর কাঁপতে থাকে, নৌকা তখন বারবার কাৎ হয়ে যায়। হয়তো শেফালী পড়ে যাওয়ার পর নৌকা স্থির হওয়ার আগে আবুল হাশিমও ঝাঁপিয়ে পড়ে দেমাগী মহুয়া নদীর জলে। — স্রোতের যতটুকু টান ছিলো, তাতে একহাত তুলে ধরে, দুই হাত তুলে ধরে, পানি খেতে খেতে, ডুবে যেতে যেতে, শেফালী তলিয়ে যায় নদীর গভীর জলে; আবুল হাশিম তার নাগাল পায় না। সে হাউমাউ করে কাঁদে আর প্রাণপণে ফিরে যেতে থাকে শেফালীর বিপরীতে।
শেষে বালুচরের দিকে, নদীর জল যেখানে শেষ হয়, যেখানে ভাদ্রমাসে কাশফুল ফুটে রয়, সুইচোরা পাখি উড়ে বেড়ায়; পানি খেতে খেতে আবুল হাশিম সেখানে ফিরে আসে এবং ভেজা বালুর গায়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়। গ্রামে যেমন হয়, — একটি লোক থাকে কীভাবে যেন সবকিছু দেখে ফেলে, শুনে ফেলে, বুঝে ফেলে, এবং লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরু চুলকায়, আর রহস্যজনকভাবে হেসে হেসে টাকা চায়; এসে আবুল হাশিমের সামনে দাঁড়ায় এবং কীভাবে যেন গ্রামে ফিরে গিয়ে লোক ডেকে আনে। তারা আবুল হাশিমকে বাঁচিয়ে তোলে।
সেই দিন থেকে রশিদ কাকার বৌ জোহরা চাচী বলাবলি করে, — মাইয়া মাইনষের এত তরতরানি ভালা না, ব্যাটা মাইনষের মতন গেরামে গেরামে ঘুইরা বেড়ানি ভালা না। মা গো মা, নিজেতো মরছে মরছে আমগো হাশিমরেও মারতে লইছে! কেমন ডাকাইত মাইয়া একটা।
আজ এই ভাদ্র মাসের দুপুরে মহুয়া নদীর তীর থেকে বৃদ্ধ আবুল হাশিম একা একা বাড়ি ফিরে আসে, ঘরে ফিরে আসে। তার ঘরভর্তি মানুষ। সে উঁকি দিয়ে দেখে মৃত্যুপথযাত্রী আবুল হাশিম বিছানায় শুয়ে আছে এবং তাকিয়ে আছে ঘরের বেড়ার দিকে, যেখানে ঝুলে রয় শুকনো ফুলের মালাসহ শেফালীর ছবি।
আবুল হাশিমের পিপাসা পায়, পিপাসায় বুক ফেটে যায়। এই জীবনে শেষবারের মতো আবুল হাশিম মন ভরে জল খেতে চায়।
কারো মৃত্যুর সময় যেমন হয়, — আপনজনেরা মেলামাইনের বাটিতে করে সামান্য পানি এনে কয়েক ফোটা তুলে দেয় মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে। আবুল হাশিমের তাতে কিছু হয় না। তার জিহ্বা ভিজে না, গলা ভিজে না, প্রাণ ভিজে না। একটা হ্যাঁচকা টানে বাটির সব জল মুখের ওপর ঢেলে জীবনের সমস্ত গ্লানি মেনে নিয়ে আবুল হাশিম তলিয়ে যায় মহুয়া নদীর জলে।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।